দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যমগুলাে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকবাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের আটক করে, ফলে তেমন খবরাখবর বিশ্ব জানতে না পারলেও সবকিছু এড়িয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংক ২৭ মার্চ সারা ঢাকা শহর ঘুরে ২০ রােল ছবি তােলেন এবং তা জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে লন্ডনে পাঠান। এরপর লন্ডনের টেলিগ্রাফে তিনি ঢাকার গণহত্যার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও মে মাসে পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি। ম্যাসকারেনহাস সারাদেশে কিভাবে গণহত্যা চালানাে হচ্ছে তা তুলে ধরেন। ম্যাসকারেনহাস এর প্রতিবেদন প্রকাশের পর সারা বিশ্ব গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এসব কতিত্নের একমাত্র দাবিদার বিদেশি গণমাধ্যমগুলাে।।
জাতীয় পতাকা তৈরির নেপথ্যের কাহিনী
জনমত গঠন : স্বদেশি গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যমগুলােও বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করে। বিশেষ করে বিবিসি, আকাশবাণী, অস্ট্রেলিয়া বেতার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছে। বিবিসির মার্ক টালির। প্রতিবেদন ও আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রাজনৈতিক ভাষ্য শােনার জন্য বাঙালিরা উন্মুখ হয়ে থাকত। এসব গণমাধ্যমে প্রচারিত বার্তা বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। । ৪. সমর্থন আদায় : বিদেশি প্রচার মাধ্যমগুলাে নিয়মিত বাংলাদেশের গণহত্যার খবর, পাকবাহিনীর হত্যা, লােমহর্ষক কাহিনী, বাঙালিদের দুর্দশার খবর প্রচার করতাে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত অর্জন সহজ হয়। এমনকি পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্র মার্কিন জনগণও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরাে অন্যান্য দেশের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন করেছিল। এসব সম্ভব হয়েছিল বিদেশি গণমাধ্যমের কল্যাণেই। ৫. বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের গণমাধ্যমের ভূমিকা ; ভারতের গণমাধ্যমগুলাে বাংলাদেশের। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্ব দরবারে সুচারুরূপে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। ভারত ছাড়াও জাপান, ব্রিটেন, রাশিয়া। তথা তল্কালীন সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচার মাধ্যমগুলাে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরত। এসব দেশের সাধারণ জনগণ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এমনকি আমলারাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন। করেছিল। এসব সম্ভব হয়েছিল বিদেশি প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে।
এসব গণমাধ্যমের অবদানের কারণে আমরা অনেক জীবন হারালেও অতি অল্প সময়ে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ লাভ করতে পেরেছি। উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশি। গণমাধ্যমগুলাে যে অবদান রাখে তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা দেশীয় প্রচার মাধ্যমগুলাে এদেশের জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে এবং বিদেশি গণমাধ্যমগুলাে বিশ্ব জনমত গঠনের মাধ্যমে দখলদার। রাষ্ট্রকে চাপে রাখা এবং মুক্তিকামী জনগণের সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ( 33 প্রশ্ন : ৩৩। । ” অথবা, জাতীয় পতাকা তৈরির ইতিহাস সংক্ষেপে উল্লেখ কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মােৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে একটি পতাকা ব্যবহার করা হতাে, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল। জাতীয় পতাকা তৈরির নেপথ্যের কাহিনী : ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধান। ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অংশগ্রহণের কথা ছিল।
এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয় বাংলা বাহিনী’ মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্রনেতা। এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল। হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরাে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রল নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদ হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলােচনা শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে। হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান (নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স) থেকে বড় এক টুকরাে সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত, সেলাই করে। আনেন; এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে। তিতমীর হল) এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের | মানচিত্র। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন আ.স.ম আব্দুর রব। স্বাধীনতা ঘােষণার প্রাক্কালে ২৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানও তার বাসভবনে এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাসের। ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে। কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। । 33 প্রশ্ন : ৩৪। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা সংক্ষেপে আলােচনা কর। অথবা, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের গৌরবােজ্জ্বল
ভূমিকা : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের গৌরবােজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান। আমলে পাকিস্তান বিরােধী প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত। প্রতিটি সংগ্রামে রয়েছে বাংলার ছাত্রসমাজের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছে । এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১. মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা/ অবদান : মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়কারী হিসেবে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএফএল) বা মুজিববাহিনীর সমন্বয়কারীদের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, উত্তরাঞ্চলে সিরাজুল আলম খান, পশ্চিমাঞ্চলে আব্দুর রাজ্জাক, দক্ষিণাঞ্চলে তােফায়েল আহমেদ।
প্রশিক্ষণ শিবির চালানাে : মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। ছাত্র নেতাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্বে ছিল তৎকালীন ডাকসু সহ-সভাপতি আ. স. ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দস মাখন, পূর্বাঞ্চলে ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলাম ও কাজী আরেফ আহমেদ যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে, এবং। ছাত্রলীগ সভাপতি নুর-ই-আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ।। ৩. স্বাধীন বাংলা বেতারে : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগ্রামী ছাত্রনেতারা। জনগণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষণ দিয়ে তাদেরকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করাসহ উপযুক্ত দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে গণযুদ্ধে রূপান্তরিত করতে অসামান্য অবদান রাখে। ৪. মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ : ছাত্রসমাজের বড় একটা অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তারা। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং দেশে ফিরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেয়। যে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা তার একটি উল্লেখযােগ্য অংশই ছিল বাংলার তকালীন ছাত্রসমাজ।
জনমত গঠন : ছাত্ররা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রচার ও প্রচারাভিযানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অবদান অপরিসীম। কেননা, মুক্তিবাহিনীর। অধিকাংশ সদস্যই ছিল ছাত্রদের মধ্য থেকে উঠে আসা। এমনকি বাংলাদেশের মানচিত্র ও পতাকা এ ছাত্রদেরই সৃষ্টি। ৩৩ প্রশ্ন : এ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকা লিখ। অথবা, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীদের অবদান সম্পর্কে লিখ।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান উল্লেখ কর। উত্তর : ভমিকা : আবহমানকাল ধরে বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যে নারীসমাজ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলার সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও নারীর বিশেষ অবদান যেমন রয়েছে, তেমনি অবদান রয়েছে আন্দোলন এ। সংগ্রামে। প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূখণ্ডে নারীসমাজ বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত থেকে আন্দোলন-সংগ্রামকে সফল করেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও এদেশের নারীসমাজের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীসমাজ প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েন, আবার অনেকে পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজের ভূমিকা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলাে : ১. রণাঙ্গনে নারী : বাংলার নারীসমাজও পুরুষের সাথে সশস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়ে। অনেকে। গুপ্তঘাতকের মতাে করে শত্রু নিধন করেন আবার অনেকে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য। অবদানের জন্য তারামন বিবি ও ডা. সেতারা বেগম বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
আরো পড়ুন: