একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা, শােকাকুল, কামানের গােলায় পুলিশ লাইন ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই.পি. আর এর বঙ্গশার্দুল সম্পূর্ণ অন্ধভাবে স্ব-স্ব দায়িত্ব মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরােধ সংগ্রামে, ঠিক তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্ম। এই বেতারের প্রথম অনুষ্ঠান শােনামাত্র বহু বাঙালি অঞ সংবরণ করতে পারেন নি। বাঙালি আবার উঠে। দাড়ায় গভীর আত্মবিশ্বাসে।
বীর বঙ্গশার্দুলেরা পান শক্রর উপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে পৃথিবীর । জাতিসমূহের কাছে জানানাে হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতি তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি ও সহযােগিতা দানের আহ্বান।। ৮. বিনােদনের ব্যবস্থা : সে সময় অন্যকোনাে কেন্দ্র বা টিভি ছিল না। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জনগণ। ও মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত লােকদের বিনােদনের ব্যবস্থা করেছে। ৯. আশার বাণী শােনানাে : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জনগণকে সর্বদা আশার বাণী শুনিয়েছে। জনগণ তাই । ইতিবাচক খবর শুনে আশায় বুক বেঁধেছে।।
যােগসূত্র : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সার্বিক যােগসূত্র স্থাপন করে। এ কেন্দ্র ব্যাপক অবদান রাখে ।। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ ইউনিটসমূহও শত্রুকবলিত এলাকার সাথে সংযােগ স্থাপন করে। | উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তাৎপর্য ও অবদান প্রসঙ্গে শামসুল হুদা চৌধুরীর সাথে সুর মিলিয়ে আমরা বলতে পারি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল। তাৎপর্যবাহী।” এ বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ নয় মাস ধরে অমিততেজ, তেজস্বিনী ভাষা আর দৃপ্তকণ্ঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে। মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে দিশেহারা মুক্তিকামী বাঙালিকে বিজয়ের সিংহদ্বারে পৌছে দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশি প্রচার মাধ্যমের অবদান উল্লেখ কর। অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা কি ছিল? ‘ [বেগম বদরুন্নেসা স, মহিলা ক. ঢাকা, নি. প.-‘১৫]। উত্তর : ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশি প্রচার মাধ্যম ও সংবাদকর্মীরা বাংলাদেশ। প্রসঙ্গে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন শুরু করে। সেজন্য তাদের পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমগুলােতে বাংলাদেশের খবর স্থান। করে নিচ্ছিল। ২৫ মে ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পুনরায় প্রচার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আকাশবাণী।
কলকাতা, আগরতলা, শিলিগুড়ি কেন্দ্র আর বি.বি.সি বাংলার অনুষ্ঠান ছিল মুক্তিযুদ্ধের খবরা-খবর প্রচারের প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশের মানুষ এসব বেতার কেন্দ্রের খবর শুনে আশায় বুক বাধত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশি প্রচার মাধ্যমের অবদান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন। দেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম যেসকল অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে তা। নিম্নে উল্লেখ করা হলাে : ১. ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা ; বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ভারতের সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, একইভাবে বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরকে শরণার্থীদের দুর্দশা,। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শনসমূহ দেখানাের ব্যবস্থাও ভারতকে করতে। হয়েছিল।
আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। বাংলাদেশের পক্ষে মার্কিন জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর। খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। | ৩০ মার্চ, ১৯৭১ বাংলাদেশের জন্য আমরা কী করতে পারি” শিরােনামে “আনন্দবাজার পত্রিকা’ এক বিশ্লেষণধর্মী | সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পশ্চিম-বাংলার হরতাল পালিত হয়।
আর আবেদনে গণহত্যা। বন্ধ হবে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের ‘যুগান্তর পত্রিকা বলে যে, শবের পাহাড় হয়তাে বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু গণতন্ত্র অবশ্যই জয়যুক্ত হবে, বাংলাদেশ বাচবে, বাঙালিরা আবার স্বদেশে ফিরে আসবে, তবে এর জন্য প্রয়ােজন বাঙালিকে ধৈর্যশীল হওয়া, প্রচুর শক্তি, সাহস, মনােবল সঞ্চয় করা। আর ভারত দর্শক হিসেবে থাকতে পারে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দি হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা লিখে যে, পশ্চিম-বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, ড. পি. সি, চন্দ্র ও গােবিন্দলাল ব্যানার্জি যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ভারত দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারে না। তাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং মুখ খুলতে হবে।
জাপানি প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা ছিল। ইতিবাচক। জাপানের সংবাদ মাধ্যম বিশেষত ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাসমূহ, রেডিও এবং টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনন্য ভূমিকা রাখে। ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাপান সরকার এবং সর্বোপরি সাধারণ নাগরিক জাপানে তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে অনন্য অবদান রেখেছিল।